
প্রকাশিত: Sat, Apr 15, 2023 4:08 PM আপডেট: Tue, Jun 24, 2025 4:05 PM
জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আমাদের নেতা-নেত্রী এবং দেশ প্রেম
আরশাদ মাহমুদ : গত দু-তিন থেকে আমি মানসিকভাবে খুবই অশান্তির মধ্যে আছি। সত্যি কথা বলতে কী গত পরশু রাতে জাফর ভাইয়ের জানাজা টেলিভিশনের দেখার সময় আমার অজান্তেই চোখ ভিজে যায় এবং কয়েকবার মুছার চেষ্টা করেও আমি চোখের পানি সংবরণ করতে পারছিলাম না। আমার এই অনুভূতির কারণও আমার কাছে ঠিক পরিষ্কার না। কারণ জাফরুল্লাহ ভাইকে আমি তেমন একটা চিনতাম না। আমার সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছে এবং শুধু সালাম বিনিময় এবং দু-একটা সৌজন্যমূলক কথাবার্তা ছাড়া আর তেমন কোনো দীর্ঘ আলাপের সুযোগ তার সঙ্গে কখনোই হয়নি।
বলে রাখা ভালো তার পরিবারের কয়েকজনের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা আছে। তাদের মধ্যে অন্যতম ওনার ইমিডিয়েট ছোট ভাই কর্নেল এটিএমএন চৌধুরী, যাকে আমি চৌধুরী ভাই বলি। তার সঙ্গে পরিচয় ১৯৭৪ সাল থেকে এবং এখনো আমরা যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ। চৌধুরী ভাইয়ের অনুরোধে আমি কিছুদিন তার এক ছোট বোনকে উনাদের বকশিবাজারের বাড়িতে গিয়ে কয়েক মাস পড়িয়েছি। সেটা সম্ভবত ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। জাফর ভাইয়ের স্ত্রী শিরিন আমার সম্পর্কে চাচাতো বোন। শিরিনের আব্বা এবং আমার আব্বা বন্ধু ছিলেন এবং সেই সূত্রে আমি শিরিনকে চাচাতো বোনই বলতাম। জাফর ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর আমি দুজনকে একসঙ্গে দেখি ডক্টর কামাল হোসেনের বাড়িতে একটা লাঞ্চে। সদা হাস্য শিরিন এগিয়ে এসে আমাকে সালাম দেয় এবং আমি তখন হাসতে হাসতে জাফর ভাইকে বলি যে, কর্নেল চৌধুরী তো আমার অনেক দিনের পরিচিত। কিন্তু শিরীন সম্পর্কে আমার চাচাতো বোন। তিনি শুনে কিছুটা মৃদু হাসলেন।
যা হোক এখন মূল কথায় ফিরে আসি। ইতিমধ্যে আপনারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা গণমাধ্যমে তার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছেন। আমার বাড়তি কোনো কিছু বলার নেই। তবে এর মধ্যে দুটো ব্যাপার আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে এবং সেটাই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি। আপনারা জানেন তিনি বেশ কয়েক বছর জটিল কিডনি রোগে ভুগছিলেন এবং সপ্তাহে ২/৩ দিন ডায়ালিসিস করতে হতো। এই অবস্থায়ও তিনি কখনোই বিশ্রাম নেননি এবং সবসময় কাজের মধ্যে থেকেছেন।
দেশের সমস্যা নিয়ে যখনই কথা বলা প্রয়োজন ছিল তিনি নির্দ্বিধায় এবং সাহসের সঙ্গে সেগুলো বলতেন। এমনকি উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের নিয়েও তাকে একদিন বলতে শুনলাম। তিনি বলছেন আপনারা দয়া করে মাজাভাঙ্গা, মেরুদণ্ডহীন বিচারকের মতো আচরণ না করে দেশের স্বার্থে সত্য কথা বলার চেষ্টা করেন। সেটা না হলে দেশের মানুষ আপনাদের ক্ষমা করবে না। আর একবার টিভিতে দেখলাম তিনি আওয়ামী লীগের তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুসংবাদ শুনে সেখানে ছুটে আসেন এবং তাকে দাঁড়িয়ে স্যালুট করেন।
এবার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। বিভিন্ন সংবাদে জানলাম তার অবস্থা গত দুবছর থেকে জটিল হতে থাকে এবং পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে বিদেশে গিয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার জন্য চাপাচাপি করা হয়। তিনি তাদের সেই চাপ উপেক্ষা করে বলেছেন যে দেশের অনেক মানুষ কিডনি রোগের চিকিৎসা করতে পারছেন না। তাদের বিদেশে গিয়ে ট্রান্সপ্লান্ট করার তো প্রশ্নই আসে না। সেখানে আমি কীভাবে বিদেশে যে এই কাজটা করবো। সত্যি কথা বলতে কি বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া তার জন্য অত্যন্ত সহজ ছিলো। কারণ আমি যতদূর জানি তিনি ব্রিটিশ নাগরিকও এবং নিজে একজন ডাক্তার। ফলে ইচ্ছে করলে তিনি সহজেই যেতে পারতেন। কিন্তু দেশ এবং জাতির কথা চিন্তা করে তিনি কখনোই সেটা করেননি। কারণ সেটা করলে তিনি হিপোক্রেট হিসেবে পরিচিত হতেন।
এবার আমাদের দেশের নেতা-নেত্রী এবং সুবিধাভোগী শ্রেণির কথা চিন্তা করেন। তারা কারণে অকারণে সামান্য মেডিকেল চেকআপের জন্য সিঙ্গাপুর, লন্ডন, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে চলে যান। কয়েকদিন আগে দেখলাম রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ৬১ জন সদস্য নিয়ে সিঙ্গাপুরে গেলেন চেকআপ করানোর জন্য। এদের মধ্যে ১৩ জনই তার পরিবারের সদস্য। এছাড়াও ছিলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রায় আট জন কর্মকর্তা। আমি একটা জিনিসই বারবার নিজের কাছে প্রশ্ন করছিলাম যে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য গেলে সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এতজন সদস্যের উপস্থিতি কি প্রয়োজন ছিলো। এছাড়াও তার সচিব, সামরিক সচিবের পরিবারদের নিয়ে যাওয়ারইবা কি প্রয়োজন ছিলো।
এখানেই জাফর ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের তথাকথিত দেশপ্রেমিক নেতা-নেত্রী এবং অন্যান্য সুবিধাভোগী শ্রেণির পার্থক্য বোঝা যায়। কথায় কথায় বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া কীভাবে তারা জাস্টিফাই করেন এটা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না। শুধু তাই নয়, তাদের সঙ্গে যে বিরাট সফর সঙ্গীরা থাকেন এদের তো খরচ সম্পূর্ণভাবেই রাষ্ট্রকে বহন করতে হয়। আমার মনে প্রায়ই একটা প্রশ্ন দেখা যায় যে এদের যদি নিজের পয়সা খরচা করে বিদেশে চিকিৎসা করাতে হতো তাহলে এরা যেতেন কিনা। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এদের কি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা ডাক্তারদের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। অথচ এরাই আমাদের নিয়মিত দেশপ্রেম সম্পর্কে সবক দিচ্ছেন।
আর একটি কথা বলে এই পোস্টটা শেষ করছি। দেশপ্রেম আসলে কি এবং জাফরউল্লাহ চৌধুরী যে নজির স্থাপন করলেন সেটাই কি প্রকৃত দেশপ্রেম না? পরিশেষে আমি এই মহান দেশপ্রেমিক আপাদমস্তক সৎ, সাহসী লোকটির প্রয়াণে আল্লাহর কাছে শুধু এটাই বলব যে হে আল্লাহ তুমি জাফর ভাইয়ের মতো আরও কিছু লোক আমাদের দেশে পাঠাও। লেখক: সাংবাদিক
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
